গল্পঃ প্রথম দর্শনে প্রেম
লেখকঃ ইসহাক মাহমুদ
অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করলাম। ঠিকটাক মতো পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করতে পারলে গ্রাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি পাবো। এরপর ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথায়,পরিবারকে একটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা। এতকিছুর ভীড়ে প্রেম ভালোবাসা নামক সম্পর্কে নিজেকে জড়ানোর কোনো ইচ্ছেই ছিলো নাহ মাথায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মাথায় প্রেম ভালোবাসার চেয়ে পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়াটাই মূখ্য বিষয় হয়ে থাকে। যদিও গুটিকয়েক ঠিক ই প্রেম ভালোবাসায় সংযুক্ত হয়,তবে তাদেরকে চাপের মুখেও থাকতে হয় প্রায় সময়।
আমার কাছে ভালোবাসা'টা কেমন জানি পানসে পানসে লাগতো। অভাবের সংসারে ভালোবাসার কদর খুব একটা হয় নাহ। এভাবেই চতুর্থ বর্ষের ২ মাস কেটে গেলো। খুব একটা ক্লাস করতে পারিনি এই দুই মাসে। বাবার ব্যবসায় সময় দেওয়া আর টিউশনি নিয়েই আমার সময় পাড় হচ্ছিলো। একদিন একটা বিশেষ ক্লাস থাকায় ভার্সিটিতে যেতে হলো।
ডিপার্টমেন্টর দিকে ডুকতেই একটা নতুন মুখ চোখের সামনে দেখা দিলো। যদিও এর আগে এই মুখ কখনোই দেখিনি,তবুও আমার কেনো জানি মনে হচ্ছিলো এই মুখ আমার চিরপরিচিত। হাজার বছর আগেও আমি এই মানুষটাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি,মানুষটার সাথে মিশেছি। বুকের ভিতর ভূকম্প শুরু হয়ে গেলো এক নিমিষেই। আমি ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলাম,সামনের দিকে আমার পা এগুচ্ছে নাহ। এমন অপ্সরীর মতো মানবী চোখের সামনে থাকলে যেকোনো যুবক ই থমকে যাবে,হারিয়ে যাবে কল্পিত কোনো রাজ্যে। আমারও একই উপক্রম হলো,আমিও নিজেকে উড়িয়ে নিয়ে গেলাম স্বপ্নপুরীতে।
হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে আসতেই মতিভ্রম ভুলে কল্পনার রাজ্য ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলাম। একি! এ তো সেই মানবী,যাকে দেখেই আমার মতিভ্রম শুরু হয়েছিলো। আমার সামনে এসেই সুন্দরী মানবী জিজ্ঞেস করলো--
-- আপনি কি এই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট?
- প্রত্যুত্তরে আমি বললাম,হ্যাঁ আমি এই ডিপার্টমেন্টের ই। ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।
-- ওহ ভাইয়া,আসলে আমি এই ডিপার্টমেন্টে নতুন ভর্তি হতে এসেছি। আসলে কিভাবে কি করতে হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি নাহ। যদি একটু সাহায্য করতেন তাহলে উপকৃত হতাম।
-- আচ্ছা তোমার কাগজপত্র গুলো দেখি।
কাগজপত্র গুলো হাতে নিয়ে চেক দিয়ে দেখলাম ওর নাম "নিহা খন্দকার "। চেহারার সাথে নামের অপূর্ব মিল। ওর উদ্দ্যেশ্যে বললাম--
-- তোমাকে সর্বপ্রথম টাকা ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে,তারপর ব্যাংক ড্রাফটের কাগজ এবং এসএসসি ও ইন্টারমিডিয়েট এর কাগজপত্র জমা দিয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মেয়েটা আমাকে প্রত্যুত্তরে বলতে লাগলো--
-- আমি আসলে এখানকার কিছুই চিনি নাহ। আপনি তো পুরাতন স্টুডেন্ট,আমার ভর্তি নিশ্চিত হওয়া অব্ধি যদি একটু সাহায্য করতেন আর কি।
এমন রূপবতী কন্যার কথা কি আর ফেলা যায়! যদিও " ভাইয়া" ডাক টা বিরক্তিকর লাগতেছিলো। রূপবতীদের মুখে ভাইয়া ডাক শুনার ইচ্ছে কোনো যুবকের ই নেই। পারিবারিক ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। ওকে সাথে নিয়ে ভার্সিটির গেইটের কাছে আসলাম। এখান থেকে যমুনা ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসতে হবে। ৭/৮ মিনিট হাটলেই যমুনা ব্যাংকে পৌঁছানো যাবে,তবুও হাটতে ইচ্ছে হলো নাহ। এমন অপ্সরীর পাশে হাটার চেয়ে পাশে বসেই যাওয়া ভালো। তাই রিক্সা ডাক দিয়ে রিক্সাতে উঠলাম। পাশাপাশি দুজন,উদ্দেশ্য যমুনা ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংক ড্রাফট করা। হেটে গেলে যে পথে ৭/৮ মিনিট লাগে,সেই পথে রিক্সায় যেতে ১৫ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল জ্যামের কারণে। অবশ্য কোনো সুন্দরী রমণীর পাশে বসলে ৫ মিনিটের পথে ৫ ঘন্টার জ্যাম ও সহনীয় হয়ে যায়। ক্লান্তি কিংবা বিরক্তির কোনো ছাপ আসেনা মুখের কোণায়। তখন মন পঙ্খীরাজে করে উড়তে থাকে হাওয়ার শহরে,এই শহরে মিনিটের কাটা ৩৬০০ সেকেন্ডে একবার ঘোরে।
গত পনের মিনিটে নিহা আমাকে কম করে হলেও পনের হাজার কথা জিজ্ঞেস করেছে। কই থাকি,বাড়িতে কি করি,বাসায় কে কে আছে,কয় ভাই-কয় বোন,বাবা কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় তো হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলো বিয়েসাদী করেছি কিনা। তখন প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলাম। কিরে বাবা,পড়াশোনায় অধ্যয়নরত কোনো ছেলেকে হুট করে কোনো মেয়ে এমন প্রশ্ন করে! জীবনে প্রথমবারের মতো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। যাক,অবশেষে ঠিকঠাক মতোই বলে দিয়েছি আমি যে এখনো সিঙ্গেল তত্ত্ব অনুসরণ করে পথ চলছি। তবে একটা কথা মনে করে খুব তাজ্জব হয়ে গেলাম,এই মেয়ে একটিবারের জন্যও আমার নাম জানতে চাইলো নাহ। নাম জানা ছাড়াই একটা ছেলের পাশে বসে একটা মেয়ে এতো সানন্দে রিক্সায় চড়ে কি করে! হয়তো প্রয়োজনের তাগিদেই ব্যস্ত শহরের পথটায় ১৫ মিনিটের ভ্রমণ করেছে৷
আমরা সরাসরি যমুনা ব্যাংকের সামনে গিয়ে নামলাম। ওরে রিক্সা ভাড়া দিতে চাইলে আমি বারণ করলাম৷ কোনো রমণীর ভাড়ায় রিক্সা ভ্রমণ মানা যায়না,বিমানের ভ্রমণ হলে সেটা অন্য বিষয় ছিলো। যাইহোক,রিক্সাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে আমরা ব্যাংকের ভিতরে ডুকলাম। গত চার বছর এখানে পড়াশোনা করার কারনে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে আমার ভীষণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ভিতরে ডুকতেই সেকেন্ড ম্যানেজার রাসেল ভাই সালাম দিলেন,আমিও সালাম বিনিময় পর্ব টা সেরে নিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কি জন্য এসেছি,প্রত্যুত্তরে বললাম কিছু টাকা ব্যাংক ড্রাফট করবো। তিনি পিয়ন কে ডেকে একটা ব্যাংক ড্রাফটের কাগজ দিলেন৷ নিহাকে দিয়ে কাগজটা পূরণ করিয়ে তাকে সিরিয়ালে দাঁড় করিয়ে দিলাম টাকা জমা দেওয়ার জন্য। মেয়েদের সিরিয়ালে ছেলেদের দাঁড়ানোর নিয়ম নেই,নাহলে টাকা জমা দেওয়ার কাজটাও আমার করা লাগতো। একে একে সিরিয়াল সামনের দিকে এগুচ্ছে,আর আমি দূর থেকে ওর মায়াবী মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
ভাবতে লাগলাম- স্বর্গ থেকে কোনো পরী যেনো আমার জন্য জমিনে নেমে এসেছে,এই বুঝি আমাদের প্রেম জমে উঠলো। ভাবনার জগতে দোল খেতে খেতেই সময় কাটিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ। নিহা টাকা ব্যাংক ড্রাফট করেই আমার সামনে এসে বললো,"চলুন,এখানকার কাজ শেষ।" এরপর আমরা ব্যাংক থেকে বাহিরে বেরিয়ে এসে পূনরায় রিক্সায় উঠলাম। আসার পথে ওকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি,তাই প্ল্যান করে নিলাম যাওয়ার পথে প্রশ্নের ভার টা আমার কাধে-ই চাপিয়ে নিবো। যেই ভাবা সেই কাজ--
-- আচ্ছা নিহা তোমার বাসায় কে কে আছে?
-- প্রত্যুত্তরে নিহা বললো,"নামটা দেখছি মগজে ফিট করে নিয়েছেন! কাহিনী কি?
-- তোমাকে যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দাও।
-- আমরা দুই ভাইবোন ও আমার মা আছে। "
-- তোমার বাবা?
-- বাবা নেই,উনি আরো চার বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। (একটু গম্ভীর হয়ে)
-- ইন্না-লিল্লাহ....... সরি,আসলে তোমার বাবার জিজ্ঞেস করে বোধহয় তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
-- আরে নাহ,কষ্ট দেওয়ার মতো কিছুই হয়নি।
-- ভাইবোনের মধ্যে তুমি ই কি সবার ছোট? তোমার ভাই কি করে?
-- নাহ,আমার ভাই আমার দুই বছরের ছোট। সে এবার ইন্টারমেডিয়েট প্রথম বর্ষে আছে। এলাকার একটি কলেজ থেকে পড়াশোনা করছে।
-- তোমার আম্মা কি করে?
-- উনি আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আছেন। আব্বা আগে চেয়ারম্যান ছিলেন,সেই সুবাধে আব্বা মারা যাওয়ার পরে এলাকার মানুষ আম্মাকে চেয়ারম্যান পদে আসন পাকাপোক্ত করে দিয়েছেন। এলাকার মানুষের সেবা নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন। আমার আব্বাও সারাজীবন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
এরপর আর তেমন কোনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি,এরচেয়ে বেশি প্রশ্ন করলে মেয়েটা হয়তো বাবার শোকে কেঁদেই ফেলবে।
রিক্সা থেকে ভার্সিটির গেইটের সামনে গিয়ে নামলাম। এবারও ভাড়া চুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা আমার কাঁধেই নিলাম। নিহা অনেক জোর করেছিলো ভাড়াটা নিজে দেওয়ার জন্য,কিন্তু আমার জন্য দিতে পারেনি। আমি ভিতরে ভিতরে ভাবতে লাগলাম,"সবেমাত্র তোমার রিক্সা ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছি,পুরোটা জীবন তোমার দায়িত্ব নেওয়ার জন্যেও আমি প্রস্তুত হয়ে আছি।" কোনো সুন্দরী রমণীর প্রতি একবার ভালোবাসা জন্মে গেলে তার পুরোটা জীবনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যুবকের মন চটপট করতে থাকে। মেয়েরা অবশ্য এই জিনিসটা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে,"কে তাকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখছে,কে তাকে কামুকতার দৃষ্টিতে দেখছে।" তাদের উপলব্ধি শক্তি প্রখর।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এতক্ষণে ডিপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছে গেলাম। আজ আর গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস টা করা হলো নাহ। রূপবতীদের জন্য এমন হাজারটা ক্লাস মিস দেয়া ই যায়,এতে ক্ষতির চেয়ে লাভ টা ই বেশি। ডিপার্টমেন্টের কেরানির কাছে গিয়ে নিহার ভর্তি প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করে দিলাম। এরপর বাহিরে বেরিয়ে এসে নিহাকে জিজ্ঞেস করলাম--
-- ভর্তি প্রক্রিয়া তো শেষ হলো,এবার কি করবে?
-- কি আর করবো,বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
-- তোমাদের বাড়ি কোথায়?
-- কুমিল্লাতে।
-- কি বলো!! আমার বাড়িও তো কুমিল্লায়। কুমিল্লার কোথায়?
-- সুয়াগাজি উপজেলায়।
-- আমার আর তোমার বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি দূরে নাহ। ১৫/১৬ কিলোমিটার হবে। আমাকেও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। চলো একসাথে যাওয়া যাক,কি বলো?
-- আচ্ছা চলেন। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো করবো ভেবে এতক্ষণেও জিজ্ঞেস করা হলো নাহ।
-- কি কথা? বলে ফেলো নিঃসন্দেহে।
-- আমার নাম তো চুরি করেই মুখস্থ করে নিলেন। কিন্তু আপনার নাম টা তো জানা ই হলো নাহ। কি নাম আপনার?
-- অধমের নাম ইসহাক মাহমুদ। বন্ধুমহলে অবশ্য আরো কয়েকটা খ্যাতনামা নাম আছে,সেগুলো আজ না হয় গোপন-ই থাকুক৷ চলো এখন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়া যাক।
-- আচ্ছা চলুন তাহলে।
বাড়ির উদ্দেশ্যে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসলাম। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে গাড়ির দেখা মিললো। উঠে কোনোমতে বাসের পিছনে বাম কোণায় দুটো ফাঁকা সিট পেলাম। নিহাকে জানালার পাশে বসতে দিয়ে আমি তার পাশের সিটে বসলাম। মেয়েদের জানালার পাশের সিটেই মানায়,কেননা সেখানে বসলে বাতাসে তাদের কাজলকেশর উড়ার সুন্দর দৃশ্যটি উপভোগ করা যায়। চুলের মাতাল করা ঘ্রাণে নিজেকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়। চলন্ত বাসে তার উড়ন্ত চুলের মাতাল করে গন্ধে নিজেকে একপ্রকার হারিয়েই ফেলেছিলাম। পাশাপাশি সিটে প্রায় ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিয়ে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছালাম৷ বাস থামলেও আমার মন থামতে চাইছিলো নাহ। মন কেবল তার সাথে ছুটে যেতেই চাচ্ছিলো৷ সে যে আমার হৃদয়ে প্রথম দর্শনে প্রেম জাগিয়ে তোলা রমণী। তারে ছেড়ে কি যাওয়া যায়!!
তার অজান্তেই একটা চিরকুটে আমার ফোন নাম্বার আর দুটো লাইন ছুড়ে এলাম তার কাধে থাকা ব্যাগে। যদি সে দেখতে পায়,তবে হয়তো তার চোখের সামনে সেই দুটো লাইন ভেসে উঠবে। যেখানে লেখা ছিলো -
"প্রথম দেখাতেই হৃদয়ে আমার করলে আক্রমণ,
তুমি আমার 'প্রথম দর্শনে প্রেম' জাগানো অতি আপনজন।"
অপেক্ষায় আছি,হয়তো সে ফোন করবে বলে। এমন একজনের জন্য চাইলে হাজার বছরও অপেক্ষা করা যায়। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়৷ দুয়েক'শত মাইল দূর থেকেও তাকে কাছের মানুষ ভাবা যায়৷ বোকাসোকা ভাবলেও হাসতে হাসতে আপন ভাবা যায়৷ একান্তই নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করা যায়।
লেখকঃ ইসহাক মাহমুদ
অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করলাম। ঠিকটাক মতো পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করতে পারলে গ্রাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি পাবো। এরপর ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথায়,পরিবারকে একটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা। এতকিছুর ভীড়ে প্রেম ভালোবাসা নামক সম্পর্কে নিজেকে জড়ানোর কোনো ইচ্ছেই ছিলো নাহ মাথায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মাথায় প্রেম ভালোবাসার চেয়ে পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়াটাই মূখ্য বিষয় হয়ে থাকে। যদিও গুটিকয়েক ঠিক ই প্রেম ভালোবাসায় সংযুক্ত হয়,তবে তাদেরকে চাপের মুখেও থাকতে হয় প্রায় সময়।
আমার কাছে ভালোবাসা'টা কেমন জানি পানসে পানসে লাগতো। অভাবের সংসারে ভালোবাসার কদর খুব একটা হয় নাহ। এভাবেই চতুর্থ বর্ষের ২ মাস কেটে গেলো। খুব একটা ক্লাস করতে পারিনি এই দুই মাসে। বাবার ব্যবসায় সময় দেওয়া আর টিউশনি নিয়েই আমার সময় পাড় হচ্ছিলো। একদিন একটা বিশেষ ক্লাস থাকায় ভার্সিটিতে যেতে হলো।
ডিপার্টমেন্টর দিকে ডুকতেই একটা নতুন মুখ চোখের সামনে দেখা দিলো। যদিও এর আগে এই মুখ কখনোই দেখিনি,তবুও আমার কেনো জানি মনে হচ্ছিলো এই মুখ আমার চিরপরিচিত। হাজার বছর আগেও আমি এই মানুষটাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি,মানুষটার সাথে মিশেছি। বুকের ভিতর ভূকম্প শুরু হয়ে গেলো এক নিমিষেই। আমি ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলাম,সামনের দিকে আমার পা এগুচ্ছে নাহ। এমন অপ্সরীর মতো মানবী চোখের সামনে থাকলে যেকোনো যুবক ই থমকে যাবে,হারিয়ে যাবে কল্পিত কোনো রাজ্যে। আমারও একই উপক্রম হলো,আমিও নিজেকে উড়িয়ে নিয়ে গেলাম স্বপ্নপুরীতে।
হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে আসতেই মতিভ্রম ভুলে কল্পনার রাজ্য ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলাম। একি! এ তো সেই মানবী,যাকে দেখেই আমার মতিভ্রম শুরু হয়েছিলো। আমার সামনে এসেই সুন্দরী মানবী জিজ্ঞেস করলো--
-- আপনি কি এই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট?
- প্রত্যুত্তরে আমি বললাম,হ্যাঁ আমি এই ডিপার্টমেন্টের ই। ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।
-- ওহ ভাইয়া,আসলে আমি এই ডিপার্টমেন্টে নতুন ভর্তি হতে এসেছি। আসলে কিভাবে কি করতে হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি নাহ। যদি একটু সাহায্য করতেন তাহলে উপকৃত হতাম।
-- আচ্ছা তোমার কাগজপত্র গুলো দেখি।
কাগজপত্র গুলো হাতে নিয়ে চেক দিয়ে দেখলাম ওর নাম "নিহা খন্দকার "। চেহারার সাথে নামের অপূর্ব মিল। ওর উদ্দ্যেশ্যে বললাম--
-- তোমাকে সর্বপ্রথম টাকা ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে,তারপর ব্যাংক ড্রাফটের কাগজ এবং এসএসসি ও ইন্টারমিডিয়েট এর কাগজপত্র জমা দিয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মেয়েটা আমাকে প্রত্যুত্তরে বলতে লাগলো--
-- আমি আসলে এখানকার কিছুই চিনি নাহ। আপনি তো পুরাতন স্টুডেন্ট,আমার ভর্তি নিশ্চিত হওয়া অব্ধি যদি একটু সাহায্য করতেন আর কি।
এমন রূপবতী কন্যার কথা কি আর ফেলা যায়! যদিও " ভাইয়া" ডাক টা বিরক্তিকর লাগতেছিলো। রূপবতীদের মুখে ভাইয়া ডাক শুনার ইচ্ছে কোনো যুবকের ই নেই। পারিবারিক ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। ওকে সাথে নিয়ে ভার্সিটির গেইটের কাছে আসলাম। এখান থেকে যমুনা ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসতে হবে। ৭/৮ মিনিট হাটলেই যমুনা ব্যাংকে পৌঁছানো যাবে,তবুও হাটতে ইচ্ছে হলো নাহ। এমন অপ্সরীর পাশে হাটার চেয়ে পাশে বসেই যাওয়া ভালো। তাই রিক্সা ডাক দিয়ে রিক্সাতে উঠলাম। পাশাপাশি দুজন,উদ্দেশ্য যমুনা ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংক ড্রাফট করা। হেটে গেলে যে পথে ৭/৮ মিনিট লাগে,সেই পথে রিক্সায় যেতে ১৫ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল জ্যামের কারণে। অবশ্য কোনো সুন্দরী রমণীর পাশে বসলে ৫ মিনিটের পথে ৫ ঘন্টার জ্যাম ও সহনীয় হয়ে যায়। ক্লান্তি কিংবা বিরক্তির কোনো ছাপ আসেনা মুখের কোণায়। তখন মন পঙ্খীরাজে করে উড়তে থাকে হাওয়ার শহরে,এই শহরে মিনিটের কাটা ৩৬০০ সেকেন্ডে একবার ঘোরে।
গত পনের মিনিটে নিহা আমাকে কম করে হলেও পনের হাজার কথা জিজ্ঞেস করেছে। কই থাকি,বাড়িতে কি করি,বাসায় কে কে আছে,কয় ভাই-কয় বোন,বাবা কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় তো হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলো বিয়েসাদী করেছি কিনা। তখন প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলাম। কিরে বাবা,পড়াশোনায় অধ্যয়নরত কোনো ছেলেকে হুট করে কোনো মেয়ে এমন প্রশ্ন করে! জীবনে প্রথমবারের মতো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। যাক,অবশেষে ঠিকঠাক মতোই বলে দিয়েছি আমি যে এখনো সিঙ্গেল তত্ত্ব অনুসরণ করে পথ চলছি। তবে একটা কথা মনে করে খুব তাজ্জব হয়ে গেলাম,এই মেয়ে একটিবারের জন্যও আমার নাম জানতে চাইলো নাহ। নাম জানা ছাড়াই একটা ছেলের পাশে বসে একটা মেয়ে এতো সানন্দে রিক্সায় চড়ে কি করে! হয়তো প্রয়োজনের তাগিদেই ব্যস্ত শহরের পথটায় ১৫ মিনিটের ভ্রমণ করেছে৷
আমরা সরাসরি যমুনা ব্যাংকের সামনে গিয়ে নামলাম। ওরে রিক্সা ভাড়া দিতে চাইলে আমি বারণ করলাম৷ কোনো রমণীর ভাড়ায় রিক্সা ভ্রমণ মানা যায়না,বিমানের ভ্রমণ হলে সেটা অন্য বিষয় ছিলো। যাইহোক,রিক্সাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে আমরা ব্যাংকের ভিতরে ডুকলাম। গত চার বছর এখানে পড়াশোনা করার কারনে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে আমার ভীষণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ভিতরে ডুকতেই সেকেন্ড ম্যানেজার রাসেল ভাই সালাম দিলেন,আমিও সালাম বিনিময় পর্ব টা সেরে নিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কি জন্য এসেছি,প্রত্যুত্তরে বললাম কিছু টাকা ব্যাংক ড্রাফট করবো। তিনি পিয়ন কে ডেকে একটা ব্যাংক ড্রাফটের কাগজ দিলেন৷ নিহাকে দিয়ে কাগজটা পূরণ করিয়ে তাকে সিরিয়ালে দাঁড় করিয়ে দিলাম টাকা জমা দেওয়ার জন্য। মেয়েদের সিরিয়ালে ছেলেদের দাঁড়ানোর নিয়ম নেই,নাহলে টাকা জমা দেওয়ার কাজটাও আমার করা লাগতো। একে একে সিরিয়াল সামনের দিকে এগুচ্ছে,আর আমি দূর থেকে ওর মায়াবী মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
ভাবতে লাগলাম- স্বর্গ থেকে কোনো পরী যেনো আমার জন্য জমিনে নেমে এসেছে,এই বুঝি আমাদের প্রেম জমে উঠলো। ভাবনার জগতে দোল খেতে খেতেই সময় কাটিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ। নিহা টাকা ব্যাংক ড্রাফট করেই আমার সামনে এসে বললো,"চলুন,এখানকার কাজ শেষ।" এরপর আমরা ব্যাংক থেকে বাহিরে বেরিয়ে এসে পূনরায় রিক্সায় উঠলাম। আসার পথে ওকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি,তাই প্ল্যান করে নিলাম যাওয়ার পথে প্রশ্নের ভার টা আমার কাধে-ই চাপিয়ে নিবো। যেই ভাবা সেই কাজ--
-- আচ্ছা নিহা তোমার বাসায় কে কে আছে?
-- প্রত্যুত্তরে নিহা বললো,"নামটা দেখছি মগজে ফিট করে নিয়েছেন! কাহিনী কি?
-- তোমাকে যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দাও।
-- আমরা দুই ভাইবোন ও আমার মা আছে। "
-- তোমার বাবা?
-- বাবা নেই,উনি আরো চার বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। (একটু গম্ভীর হয়ে)
-- ইন্না-লিল্লাহ....... সরি,আসলে তোমার বাবার জিজ্ঞেস করে বোধহয় তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
-- আরে নাহ,কষ্ট দেওয়ার মতো কিছুই হয়নি।
-- ভাইবোনের মধ্যে তুমি ই কি সবার ছোট? তোমার ভাই কি করে?
-- নাহ,আমার ভাই আমার দুই বছরের ছোট। সে এবার ইন্টারমেডিয়েট প্রথম বর্ষে আছে। এলাকার একটি কলেজ থেকে পড়াশোনা করছে।
-- তোমার আম্মা কি করে?
-- উনি আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আছেন। আব্বা আগে চেয়ারম্যান ছিলেন,সেই সুবাধে আব্বা মারা যাওয়ার পরে এলাকার মানুষ আম্মাকে চেয়ারম্যান পদে আসন পাকাপোক্ত করে দিয়েছেন। এলাকার মানুষের সেবা নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন। আমার আব্বাও সারাজীবন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
এরপর আর তেমন কোনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি,এরচেয়ে বেশি প্রশ্ন করলে মেয়েটা হয়তো বাবার শোকে কেঁদেই ফেলবে।
রিক্সা থেকে ভার্সিটির গেইটের সামনে গিয়ে নামলাম। এবারও ভাড়া চুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা আমার কাঁধেই নিলাম। নিহা অনেক জোর করেছিলো ভাড়াটা নিজে দেওয়ার জন্য,কিন্তু আমার জন্য দিতে পারেনি। আমি ভিতরে ভিতরে ভাবতে লাগলাম,"সবেমাত্র তোমার রিক্সা ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছি,পুরোটা জীবন তোমার দায়িত্ব নেওয়ার জন্যেও আমি প্রস্তুত হয়ে আছি।" কোনো সুন্দরী রমণীর প্রতি একবার ভালোবাসা জন্মে গেলে তার পুরোটা জীবনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যুবকের মন চটপট করতে থাকে। মেয়েরা অবশ্য এই জিনিসটা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে,"কে তাকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখছে,কে তাকে কামুকতার দৃষ্টিতে দেখছে।" তাদের উপলব্ধি শক্তি প্রখর।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এতক্ষণে ডিপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছে গেলাম। আজ আর গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস টা করা হলো নাহ। রূপবতীদের জন্য এমন হাজারটা ক্লাস মিস দেয়া ই যায়,এতে ক্ষতির চেয়ে লাভ টা ই বেশি। ডিপার্টমেন্টের কেরানির কাছে গিয়ে নিহার ভর্তি প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করে দিলাম। এরপর বাহিরে বেরিয়ে এসে নিহাকে জিজ্ঞেস করলাম--
-- ভর্তি প্রক্রিয়া তো শেষ হলো,এবার কি করবে?
-- কি আর করবো,বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
-- তোমাদের বাড়ি কোথায়?
-- কুমিল্লাতে।
-- কি বলো!! আমার বাড়িও তো কুমিল্লায়। কুমিল্লার কোথায়?
-- সুয়াগাজি উপজেলায়।
-- আমার আর তোমার বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি দূরে নাহ। ১৫/১৬ কিলোমিটার হবে। আমাকেও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। চলো একসাথে যাওয়া যাক,কি বলো?
-- আচ্ছা চলেন। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো করবো ভেবে এতক্ষণেও জিজ্ঞেস করা হলো নাহ।
-- কি কথা? বলে ফেলো নিঃসন্দেহে।
-- আমার নাম তো চুরি করেই মুখস্থ করে নিলেন। কিন্তু আপনার নাম টা তো জানা ই হলো নাহ। কি নাম আপনার?
-- অধমের নাম ইসহাক মাহমুদ। বন্ধুমহলে অবশ্য আরো কয়েকটা খ্যাতনামা নাম আছে,সেগুলো আজ না হয় গোপন-ই থাকুক৷ চলো এখন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়া যাক।
-- আচ্ছা চলুন তাহলে।
বাড়ির উদ্দেশ্যে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসলাম। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে গাড়ির দেখা মিললো। উঠে কোনোমতে বাসের পিছনে বাম কোণায় দুটো ফাঁকা সিট পেলাম। নিহাকে জানালার পাশে বসতে দিয়ে আমি তার পাশের সিটে বসলাম। মেয়েদের জানালার পাশের সিটেই মানায়,কেননা সেখানে বসলে বাতাসে তাদের কাজলকেশর উড়ার সুন্দর দৃশ্যটি উপভোগ করা যায়। চুলের মাতাল করা ঘ্রাণে নিজেকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়। চলন্ত বাসে তার উড়ন্ত চুলের মাতাল করে গন্ধে নিজেকে একপ্রকার হারিয়েই ফেলেছিলাম। পাশাপাশি সিটে প্রায় ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিয়ে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছালাম৷ বাস থামলেও আমার মন থামতে চাইছিলো নাহ। মন কেবল তার সাথে ছুটে যেতেই চাচ্ছিলো৷ সে যে আমার হৃদয়ে প্রথম দর্শনে প্রেম জাগিয়ে তোলা রমণী। তারে ছেড়ে কি যাওয়া যায়!!
তার অজান্তেই একটা চিরকুটে আমার ফোন নাম্বার আর দুটো লাইন ছুড়ে এলাম তার কাধে থাকা ব্যাগে। যদি সে দেখতে পায়,তবে হয়তো তার চোখের সামনে সেই দুটো লাইন ভেসে উঠবে। যেখানে লেখা ছিলো -
"প্রথম দেখাতেই হৃদয়ে আমার করলে আক্রমণ,
তুমি আমার 'প্রথম দর্শনে প্রেম' জাগানো অতি আপনজন।"
অপেক্ষায় আছি,হয়তো সে ফোন করবে বলে। এমন একজনের জন্য চাইলে হাজার বছরও অপেক্ষা করা যায়। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়৷ দুয়েক'শত মাইল দূর থেকেও তাকে কাছের মানুষ ভাবা যায়৷ বোকাসোকা ভাবলেও হাসতে হাসতে আপন ভাবা যায়৷ একান্তই নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করা যায়।
2 comments:
Thanks a lot for supporting.
Thanks for supporting @Techno prokash
Post a Comment